ٱلْـحَمْدُ لِلَّهِ وَكَفَىٰ، وَسَلَامٌ عَلَىٰ عِبَادِهِ ٱلَّذِينَ ٱصْطَفَىٰ، أَمَّا بَعْدُ، فَأَعُوذُ بِٱللَّهِ مِنَ ٱلشَّيْطَٰنِ ٱلرَّجِيمِ، بِسْمِ ٱللَّهِ ٱلرَّحْمَٰنِ ٱلرَّحِيمِ، فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَٱنْحَرْ، وقَالَ رَسُولُ ٱللَّهِ ﷺ: "مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ، فَلَا يَقْرَبَنَّ مُصَلَّانَا".
প্রিয় উপস্থিতি!
আজকের সেমিনারে আমার আলোচ্য বিষয় হলো। (কোরবানির ইতিহাস ও তাৎপর্য) আল্লাহ চাহেতো উক্ত বিষয়ের উপর কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহু তায়ালা।
সম্মানিত উপস্থিতি বক্তৃতা সহজে বুঝানোর জন্য আমি আমার আলোচ্যে বিষয়কে দুইভাগে বিভক্ত করেছি ।
(১) কোরবানির ইতিহাস
(২) কোরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত
চলুন কোরবানির ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
কোরবানি শব্দটি ‘কুরবুন’ মূল ধাতু থেকে নির্গত। অর্থ হলো নৈকট্য লাভ করা, অর্থাৎ প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গ করা। শরিয়তের পরিভাষায়, নির্দিষ্ট জন্তুকে একমাত্র আল্লাহ পাকের নৈকট্য ও সন্তুষ্টি পাওয়ার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত নিয়মে আল্লাহ তায়ালার নামে জবাই করাই হলো কোরবানি।
কোরবানি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি শুধু পশু জবাই নয়, বরং আল্লাহর জন্য ত্যাগ, ভালোবাসা ও আনুগত্যের প্রতীক। কোরবানি শুধু আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকেই নয়, বরং পূর্ববর্তী নবীগণদের সময় থেকেও চলে আসছে।
ইসলামে কোরবানির ইতিহাস অনেক প্রাচীন। এর শুরু হয় হযরত আদম (আঃ)-এর সময় থেকে, যখন তাঁর দুই পুত্র হাবীল ও কাবীল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করেন। হাবীল একটি ভালো পশু কোরবানি করায় তারটি কবুল হয়, আর কাবীল খারাপ ফসল কোরবানি করায় তা কবুল হয়নি (সূরা মায়িদা: ২৭)।
কোরবানির সবচেয়ে বড় ও শিক্ষনীয় ঘটনা হজরত ইবরাহীম (আ.) ও তাঁর পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর জীবন থেকে পাওয়া যায়। তাঁদের ত্যাগ ও আনুগত্য আজও আমাদের জন্য এক উজ্জ্বল আদর্শ।
হজরত ইবরাহীম (আ.) অনেক বছর সন্তানহীন থাকার পর আল্লাহর কাছে দুআ করে একটি নেক সন্তান লাভ করেন। তাঁর নাম ছিলো ইসমাঈল (আ.)। ছেলেটি বড় হতে লাগল, আর ইবরাহীম (আ.)-এর একমাত্র ছেলের প্রতি ভালোবাসাও বাড়তে লাগল। একদিন ইবরাহীম (আ.) স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি তাঁর ছেলেকে আল্লাহর নামে কোরবানি দিচ্ছেন।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعۡیَ قَالَ یٰبُنَیَّ اِنِّیۡۤ اَرٰی فِی الۡمَنَامِ اَنِّیۡۤ اَذۡبَحُکَ فَانۡظُرۡ مَاذَا تَرٰی ؕ
অতপর যখন সে তার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছলো, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি, (সুরা আস-সাফফাত: ১০২-১০৩)
যেহেতু নবীদের স্বপ্ন সত্য ও আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী হয়, তাই তিনি এটাকে আল্লাহর আদেশ মনে করলেন এবং ছেলেকে জানালেন। ইসমাঈল (আ.) তখন ছোট হলেও বললেন,
يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ ۖ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ
“হে পিতা! আপনি যা আদেশ পেয়েছেন তা করুন। ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।”
ইবরাহীম (আ.) ছেলেকে কাত করে শুইয়ে দিলেন এবং ছুরি চালানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে ছুরি কাজ করল না। তখন আল্লাহ তাআলা আকাশ থেকে একটি দুম্বা পাঠালেন এবং ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে সেটিকে কোরবানি করার আদেশ দিলেন।
প্রিয় উপস্থিতি
এবার আসুন কোরআন হাদিসের আলোকে কোরবানির গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে জানা যাক।
কোরবানি শুধু একটি পশু জবাইয়ের নাম নয়, এটি আল্লাহর প্রতি বান্দার এক গভীর আনুগত্য, আত্মসমর্পণ এবং তাকওয়ার প্রকাশ। এর গুরুত্ব ও ফজিলত অসংখ্য আয়াত ও হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা কোরবানিকে তাঁর নৈকট্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করেছেন:
فَصَلِّ لِرَبِّکَ وَ انۡحَرۡ
"অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ ও কোরবানি আদায় করুন।" (সূরা কাউছার: আয়াত ২)
অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন:
قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ
"(হে আমার হাবিব!) আপনি বলুন যে, অবশ্যই আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ, সব কিছুই মহান প্রতিপালকের জন্য।" (সূরা আনআম: আয়াত ১৬২)
এই আয়াতগুলো স্পষ্ট করে যে, কোরবানি আল্লাহর নির্দেশ এবং এটি বান্দার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত।
তবে আল্লাহ তায়ালা কোরবানির গোশত বা রক্তের মুখাপেক্ষী নন, বরং তাঁর কাছে পৌঁছায় বান্দার তাকওয়া ও আন্তরিকতা:
لَنۡ یَّنَالَ اللّٰهَ لُحُوۡمُهَا وَ لَا دِمَآؤُهَا وَ لٰکِنۡ یَّنَالَهُ التَّقۡوٰی مِنۡکُمۡ
"আল্লাহর কাছে (কুরবানীর পশুর)) গোশত ও রক্ত পৌঁছায় না বরং তোমাদের অন্তরের তাকওয়া পৌঁছে থাকে।" (সূরা হজ: আয়াত ৩৭)
আসুন এবার হাদিসের আলোকে কোরবানির ফজিলত সম্পর্কে জানি।
হযরত মুহাম্মদ (সঃ) কোরবানিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে পালন করেছেন। তিনি নিজে কোরবানি করতেন এবং তাঁর উম্মতের পক্ষ থেকেও কোরবানি করতেন। হাদীসে তিনি বলেন, “কোরবানির দিনে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় কাজ হলো পশু কোরবানি করা” (তিরমিযি)।
কেয়ামতের দিন জবাই করা পশুকে তার শিং ও খুরসহ হাজির করা হবে। কোরবানির জন্তুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই তা আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা খোলা মনে এবং সন্তুষ্টি চিত্তে কোরবানি করো।" (মিশকাত শরীফ)
এই হাদিস কোরবানির গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়, কারণ এটি আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমলগুলোর একটি।
অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে।
إِنَّ لِكُلِّ شَعَرَةٍ حَسَنَةً
তোমরা যে পশু কোরবানি করো, তার প্রতিটি পশমের বিনিময়ে আল্লাহ এক একটি সওয়াব দেন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَالَ " مَنْ كَانَ لَهُ سَعَةٌ وَلَمْ يُضَحِّ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مُصَلاَّنَا " .
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানী করে না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের মাঠের ধারে কাছেও না আসে। (মুসনাদে আহমদ)
এই হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি কোরবানি না করে, তা হলে সে গোনাহগার হবে এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কঠোরভাবে তার ঈদের জামাতে অংশগ্রহণকে নিরুৎসাহিত করেছেন। এর মাধ্যমে কোরবানির গুরুত্ব ও আবশ্যকতা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সম্মানিত উপস্থিতি
আজ আমরা কোরবানি দিচ্ছি, কিন্তু কোরবানির আসল উদ্দেশ্য কি পূরণ করছি? আমরা গরু-ছাগল কোরবানি করছি, অথচ অভ্যন্তরের হিংসা, অহংকার, কৃপণতা, গরীবের প্রতি অবহেলা—এই গুণগুলো জবাই করছি না!
কোরবানি মানে শুধু পশু জবাই নয়, নিজের ‘না’ বলা স্বভাবকে ‘হ্যাঁ’ বলায় রূপান্তর। যদি গরীব আত্মীয় না খায়, প্রতিবেশী বঞ্চিত থাকে, তাহলে আমাদের কোরবানির কতটুকু কবুল হবে?
প্রিয় উপস্থিতি তাই আসুন, এই কোরবানির ঈদে পশু জবাইয়ের সাথে সাথে নিজের ভেতরের পশুত্বও জবাই করি।
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য খাঁটি নিয়ত নিয়ে কোরবানি করি।
আমাদের কোরবানির পশু যেমন মোটা-তাজা হতে পারে, তেমনি আমাদের নিয়তও যেন হয় বিশুদ্ধ, তাকওয়াপূর্ণ ও একমাত্র আল্লাহর জন্য।
اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيم
وَآخِرُ دَعْوَانَا أَنِ الْـحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ।